বাড়িঅন্যভূবন

অন্যভূবন

অন্যভূবন

ময়মনসিংহ থেকে বরকতউল্লাহ সাহেব মিসির আলির সাথে দেখা করতে এসেছেন। তিনি এসেছেন তার ৯ বছরের মেয়ে তিন্নির কথা বলতে। তার বিয়ের ১১ বছর পর তিন্নির জন্ম হয়। মেয়ের জন্মের সময় তার মা মারা যায়। তিনি নিজে মেয়েকে অনেক যত্ন করে লালন পালন করেছেনে। তিন্নির এক বছর বয়েস হওয়ার পরেও সে কোন কথা বলতো না বেলে তিনি মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার বলে ওর সব কিছু ঠিক আছে হয়তো একটু দেড়িতে কথা বলবে, এরকম হয় কারো কারো ক্ষেত্রে।

কিন্তু তিন্নি ৬ বছর পর্যন্ত কোন কথা বলল না। ৬ বছর বয়সে সে কথা বলল। পুর বাক্যই একসাথে বলতে পারলো, কথা শুনে বুঝার কোন উপায় নেই যে এই মেয়ে আজকেই প্রথম কথা বলল। আরো কিছু বিষয় আছে অদ্ভুত, যেমন – তিন্নি অংক শিখেনি, কিন্তু তাকে ১৬ এর বর্গমূল কত জিজ্ঞাস করাতে সে বলে দিতে পেরেছে। তার বাবা বাইরে কার সাথে দেখা করে এসেছে সেটা সে বলে দিতে পারে। এমনকি রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘোর অন্ধকারেও সব কিছু দেখতে পারে তিন্নি। অন্য যে কারো চিন্তা সে পড়তে পারে।

মিসির আলি পরদিন রাতের ট্রেনে বরকতউল্লাহর সাথে তার বাড়িতে গেলেন। ভোরে তিনি বাড়ির বাগানে বেড়ানোর সময় দেখলেন বাগানে প্রচুর গাছ আছে, তবে কোন গাছে একটিও পাখি বসে নেই। মিসির আলি তিন্নির সাথে কথা বলেই বুঝতে পারলেন যে তিন্নি মানুষের চিন্তা পড়ে ফেলতে পারে। তাছাড়া সে রেগে গেলে যে কারো মস্তিষ্কে তীব্র ব্যথার অনুভূতি দিতে পারে। তিন্নিদের বাড়িতে অনেক কাজের লোক আছে, তাদের কারো উপর রেগে গেলেই সে ব্যথা দেয় বলে সবাই তাকে ভয় পায়। মিসির আলিকেও সেই ব্যথার মোকাবেলা করতে হল।

তিন্নি অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি আঁকে যেগুলি পৃথিবীর গাছ বলে মিসির আলির মনে হয় না। ছবি গুলিতে আকাশে দুটি সূর্য দেখা যায়। অন্যদিকে তিন্নি সেই গাছগুলিকে মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখে, গাছগুলি তার সাথে কথা বলে। আবার মাঝে মাঝেই তিন্নি সারাদিন ছাদে রোদের মধ্যে বসে থাকে। মিসির আলি আরও আবিষ্কার করলেন তিন্নি দূর থেকে যে কারো সাথে সরাসরি মস্তিষ্কের ভিতরে কথা বলতে পারে, কিন্তু সে মিসির আলি ছাড়া আর কারো সাথে এভাবে কথা বলেনি। তাছাড়া তিন্নি নিম্ন শ্রেণির প্রাণীদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারে।

মিসির আলি বুঝতে পারলেন ছোট্ট এই মেয়েটি বিচিত্র অন্য কোন ভুবনে বাস করছে। অসহায় মেয়েটির জন্য তার খুবই মায়া হতে লাগলো, তার মনে হচ্ছিলো দ্রুত সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। মিসির আলি কিছু পড়াশুনা আর তথ্য যোগাড়ের জন্য দুদিন পরেই ঢাকা ফিরে এলেন। ঢাকায় ফিরে তিনি প্রাণ আর উদ্ভিদ নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করলেন। তিন্নির আকা ছবিগুলি বিদেশে দুটি বোটানির গবেষণা কেন্দ্রে পাঠালেন। সেখান থেকে খবর এলো এ ধরনের গাছ পৃথিবীতে নেই।

তিন্নি তার বাবাকে হঠাৎ করেই বলল সে এই বাড়িতে একা থাকতে চায়। সমস্ত চাকর, কর্মচারী, দারোয়ানদের বিদায় করে দিতে হবে। এমনকি তিন্নির বাবাও থাকতে পারবেন না। কদিন পরে মিসির আলি আবার তিন্নিদের বাড়ি গেলেন। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন তিন্নি এখন সন্ধ্যার পর থেকে সারা রাত বাগানে থাকে, বাগানে সে একটি বড় গত খুঁড়েছে, সেটায় দাঁড়িয়ে থাকে।

তিন্নির বাবার সাথে আলাপ করে জানা গেলো তিন্নির নানী তিন্নির মাকে গর্ভধারণের সময় তার মাথা কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। তিনি সারাদিন রোদে বসে থাকতেন আর খাবার খেতেন না। সবাইকে বলতেন তার প্যাটে একটা গাছ বড় হচ্ছে। তিন্নির মার জন্মের পরেই তিনি মারা যান। একই ভাবে তিন্নির জন্মের সময় তিন্নির মা বলতে থাকে তার পাটে একটি গাছ বড় হচ্ছে। তিন্নির মা গর্ভবতী থাকার সময় প্রায়ই গাছ নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখতেন। তিন্নির মা তিন্নির বর্তমানের পরিস্থিতির আগাম সতর্কতা তিন্নির বাবাকে বলে গেছেন।

সব কিছু শুনে মিসির আলি ধারনা করেন, পৃথিবীতে যেমন বিবর্তনের ফলে মানুষ অতি উন্নত হয়েছে, তেমনি হয় তো অন্য কোন গ্রহে গাছেরা অতি বুদ্ধিমান হয়েছে। তারা মানুষের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তিন্নিদের মত নতুন এক প্রজন্ম তৈরির চেষ্টা করছে। তিন্নির সাথে এবিষয়ে কথা বলে তিনি আরও শিওর হলেন। কিন্তু তখনই তিন্নি বলল। মিসির আলিকে কালই ঢাকায় চলে যেতে হবে। এখানকার কথা, তিন্নির কথা কিছুই তার মনে থাকবে না।

পরদিন সকালে মিসির আলির মনে হতে থাকে তিনি ঢাকায় কোন জরুরী কাজ ফেলে এসেছেন। তিনি ট্রেনে করে ঢাকায় রওনা হয়ে যান। ট্রেনেই মিসির আলি অসুস্থ হয়ে পরেন। ঢাকা মেডিক্যালে ২ মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হন।

এক বছর পর ময়মনসিংহ থেকে একজন উকিল তাকে চিঠি দিয়ে জানান বরকতউল্লাহ নামে একজন ব্যবসায়ী তাকে একটা বিশাল বাড়ি দান করে গেছেন। বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যাংকে কিছু টাকাও রেখে গেছেন। শুধু অনুরোধ করেছেন যাতে বাড়ির বাগানের প্রতিটা গাছকেই খুব যত্ন নেয়া হয়। মিসির আলি কিন্তু বরকতউল্লাহকে চিনতে পারেন না। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন। বরকতউল্লাহর একটি অসুস্থ মেয়ে ছিল। মেয়েটি মারা যাওয়ার পরে তাকে এই বাড়ির বাগানে কবর দেয়া হয়, তার কিছু তিন পরে বরকতউল্লাহও মারা যান।

৫ বছর পরে মিসির আলি তার স্ত্রী নীলুকে নিয়ে ময়মনসিংহে তার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। বাড়ির বাগানে একটা অদ্ভুত হলদে লাল রং এর বেণির মত পেঁচানো গাছ আছে। গাছটিতে নীল রং এর ফুল, সারাদিন গন্ধ থাকে না কিন্তু রাতে প্রচণ্ড গন্ধ ছড়ায়। নীলু বাড়িটির প্রেমে পরে যায়। তারা ছুটি পেলেই এই বাড়িটিতে বেড়াতে আসে। এ বাড়িটিতেই তাদের প্রথম ছেলের জন্ম হল। নীলু একদিন হঠাৎ করেই বলল তাদের ছেলেটি মানুষ না, গাছ। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন তাদের ছেলেটি সুযোগ পেলেই ছাদে গিয়ে চুপচাপ রোদে বসে থাকে।

Read online or Download this book
হুমায়ূ়ন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ – ১৯ জুলাই ২০১২) ছিলেন একজন বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় লেখক বলে গণ্য করা হয়। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। অন্য দিকে তিনি আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। মিসির আলি এবং হিমু তার সৃষ্ট অন্যতম দুটি জনপ্রিয় চরিত্র।

তার রচিত উপন্যাস সমূহের মধ্যে রয়েছে— মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ

আরও বই